'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,
আমি কি ভুলিতে পারি?'
একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় জীবনে এক গৌরবময় ও ঐতিহ্যবাহী দিন। বাঙালির জাতীয় জীবনের সব চেতনার উৎস হচ্ছে এ দিনটি। বাঙালির গৌরব ও বেদনার ইতিহাস জড়িয়ে আছে এ দিনটির সঙ্গে।
মাতৃভাষা বিশেষ কোনো ব্যক্তি-মানুষের যেমন অন্যতম পরিচয়-উৎস, তেমনি তা একটি জাতিসত্তার অস্তিত্বেরও শ্রেষ্ঠ স্মারক। মানুষের কাছে যেসব বিষয় তার প্রাণের মতোই প্রিয়, মাতৃভাষা তার অন্যতম। বস্তুত, মাতৃভাষাই একজন মানুষের পরিচয়ের শ্রেষ্ঠতম উৎস। মাতৃভাষার মাধ্যমে বিশেষ কোনো মানুষ নিজেকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরে, তুলে ধরে তার জাতিসত্তার পরিচয়। মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে কোনো জাতিই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না, পারে না নিজের পরিচয়কে পৃথিবীতে উজ্জ্বল করে প্রকাশ করতে। যে জাতির মাতৃভাষা যত উন্নত, সে জাতি সব দিক থেকেই তত উন্নত-এমন ধারণা সর্বজনস্বীকৃত।
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বহু বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আনুমানিক ১০০০ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষা জন্ম লাভ করে। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বংশের অন্তর্গত বাংলা ভাষার জন্ম ইতিহাস বহু প্রাচীন। আজ আমরা যে ভাষায় কথা বলি, হাজার বছর আগে আমাদের ভাষা এ রকম ছিল না। বস্তুজগতের সবকিছুর মতো ভাষাও নিয়ত পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ক্রমে প্রতিষ্ঠা পায় ভাষার অভ্যন্তর শৃঙ্খলা, ভাষায় যুক্ত হয় নতুন নতুন শব্দ, ভাষা হয়ে ওঠে সহজ ও প্রাত্যহিক জীবনানুগ। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা সম্পর্কেও একথা সত্য। প্রাচীন বা মধ্যযুগে বাংলা ভাষার সঙ্গে আধুনিক যুগের বাংলা ভাষার তুলনা করলেই এ বিষয়টি আমরা সম্যক উপলব্ধি করতে পারব।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যতঃ পূর্ব পাকিস্তান অংশের বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে সমাবেশ-মিছিল ইত্যাদি বে-আইনী ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকত-সহ আরও অনেকে।
শহীদ মিনার ভাষাশহীদদের উদ্দেশে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ। ১৯৫২ সালের একুশে ফ্রেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার উদ্দেশ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে এই স্তম্ভ নির্মিত হয়, যা বর্তমানে ‘শহীদ মিনার’ নামে পরিচিত। ১৯৫৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বার শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে কাজ শুরু হয়। ১৯৬৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এ মিনার উদ্বোধন করেন শহীদ বরকতের মা হাসিনা বেগম।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এই আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুসংখ্যক ছাত্র ও কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ মিছিলের উপর গুলি চালায়। গুলিতে নিহত হন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার সহ আরো অনেকে। এই ঘটনায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষোভের আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে কেন্দ্রীয় সরকার গণ আন্দোলনের মুখে নতি স্বীকার করে এবং ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন মূলত একটি সাংস্কৃতি আন্দোলন হলেও শুধুমাত্র তার মধ্যেই এর পরিচয় সীমাবদ্ধ নয়, রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত চিন্তার একটা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চেহারা সবসময়ই ছিল। সাংস্কৃতিক বিকাশের পাশাপাশি জাতীয় অথনৈতিক বিকাশের প্রশ্নটিও এর সাথে যুক্ত ছিল।
পৃথিবীর ১০টি দেশে এই ভাষাভাষী মানুষ রয়েছে। আমাদের হিসাবে এ সংখ্যা আরও বেশি। বাংলা ভাষা শুধু বাংলাদেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষের মাতৃভাষাই নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ওডিশা, আসাম, বিহারসহ আরও কয়েকটি প্রদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ বাংলা ভাষার চর্চা করে থাকে। এ ছাড়া বাংলাদেশের বাইরে মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান, মালয়েশিয়াসহ ইউরোপের অনেক দেশে যে অসংখ্য বাংলাভাষী বসবাস করে, তারাও নিজ উদ্যোগে বাংলা ভাষা চর্চা, গবেষণা ও প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
১৯৫২ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর নতুন মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে। এই দিনে ইউনেসকো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আমাদের ভাষা আন্দোলনকে পৃথিবীর মানুষের গৌরবিত উত্তরাধিকারে রূপান্তরিত করেছে। ১ মে যেমন আন্তর্জাতিক মে দিবস, যা পালিত হয় পৃথিবীর সব দেশে, ২০০০ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি তেমনি পালিত হচ্ছে পৃথিবীজুড়ে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। পৃথিবীতে বাংলা ভাষা আজ ২৮ কোটি বা তারও বেশি মানুষের ভাষা। জনসংখ্যার বিচারে এই ভাষা সপ্তম অবস্থানে আর মাতৃভাষার দিক থেকে পঞ্চম।
সরকারি-বেসরকারি উপরের মহল থেকে হরহামেশা বলা হচ্ছে বিশ্বায়নের যুগে আমাদের টিকে থাকতে হলে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে।অতএব আমাদের ইংরেজি শিখতেই হবে। ব্যাপারখানা এই, ইংরেজি বিদ্যা অর্জন করতে না পারলে কোনো শিক্ষা আর শিক্ষা হয় না, সব বিফলে যায়। এ মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। পাশাপাশি রোধ করতে হবে বাংলা ভাষার বিকৃতিও। দেশজ ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিকাশ ও চর্চার দ্বারা বিদেশি অপসংস্কৃতি রোধ করে আমাদের মধ্যে দেশপ্রেম, স্বজাতিপ্রীতি এবং সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে হবে।
বাংলাদেশের জনগণকে আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।শুধু বাংলাদেশে নয়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বিশ্বের অন্যান্য জাতির জন্যও শিক্ষণীয় অবদান রেখেছে। ২১ ফেব্রুয়ারি আজ “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” যা শুনলেই আমাদের বুক গর্ভে ভরে উঠে, অহংকার আমাদেরকে শক্ত করে পেয়ে বসে।
Post a Comment